ডিজিটাল ডেস্কঃ আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকেই আওয়ামী লীগের ৭২ কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও মেয়রের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। তারা রীতিমতো নিখোঁজ। তবে এদের মধ্যে দলের কয়েকজন নীতিনির্ধারক নেতা নিজেদের নির্বাচনী এলাকার কর্মীদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখছেন। টেলিফোনে তাদের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। কেউ কেউ ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হয়েছেন। কিন্তু তাদের অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। নিখোঁজ এসব নেতার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করা হয়েছে। খোঁজ পেলেই পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করবে, এমনকি তাদের জনরোষের ভয়ও আছে।
ক্ষমতায় থাকাকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সক্রিয় ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ‘খেলা হবে’ কিংবা ‘পালাব না’ ইত্যাদি বলে নিয়মিত গণমাধ্যমের শিরোনাম হতেন। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর কোথাও তাঁর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়নি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে থাকা দলের নেতারা সমকালকে বলেছেন, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী দেশেই আছেন। ভারতে আত্মগোপনে থাকা নেতাদের দাবি, ওবায়দুল কাদের গত নভেম্বরে ভারতে গেছেন। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন– এমন আশঙ্কায় তিনি ভারতে আত্মগোপনে আছেন।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদও ক্ষমতায় থাকাকালে দলের সাধারণ সম্পাদকের মতো প্রতিদিন গণমাধ্যমের শিরোনাম হতেন। বিরোধী দলের তীব্র সমালোচনা করে আলোচনায় থাকতেন। ক্ষমতাচ্যুতির পর দলের এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকও আত্মগোপনে চলে যান। তিনি দীর্ঘদিন চুপচাপ থাকার পর একটি গণমাধ্যমে নিজের অবস্থান জানান দিলেও কোথায় আছেন, তা স্পষ্ট করেননি। অনেকেই বলছেন, তিনি আছেন বেলজিয়ামে।
আওয়ামী লীগ শাসনামলের শেষের দিকে ওবায়দুল কাদের ও হাছান মাহমুদের মতো গণমাধ্যমে সরব ছিলেন সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আরাফাত। অভ্যুত্থানের পর আলোচিত দুই নেতার মতো তিনিও লাপাত্তা। এই তিন নেতার কারোর সঙ্গেই কর্মীদের যোগাযোগ নেই। তবে কয়েক দিন ধরে ফেসবুকে সরব হয়েছেন মোহাম্মদ আলী আরাফাত। তবে তিনি কোথায় আছেন, সেটি কেউ জানেন না।
২৪ সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী লাপাত্তা
এ ছাড়া আরও কমপক্ষে ২৪ জন সাবেক মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর খোঁজ নেই। তারা নির্বাচনী এলাকার কর্মীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছেন না। তাদের ফোন বা হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরও সচল নয়। কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন বলেছেন, গ্রেপ্তার এড়াতে তারা আত্মগোপনে আছেন। তারা দেশে, নাকি বিদেশে আছেন– তাও স্পষ্ট নয়।
লাপাত্তা হয়ে থাকা সাবেক মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক খান দুলাল, সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন, সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম, সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি, সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান, সাবেক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শহীদুজ্জামান সরকার, সাবেক পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী আবদুল ওয়াদুদ দারা, সে সময়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা নজরুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. রোকেয়া সুলতানা, সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী শামসুন নাহার চাঁপা এবং সাবেক সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান।
এই মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের মতো সাবেক রেলপথমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলী টুসি এবং অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়েশা খানেরও কোনো খবর নেই। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আগে রুমানা আলী টুসি ও ওয়াসিকা আয়েশা খান কানাডায় ছিলেন। তারা এখনও দেশে ফেরেননি। জিল্লুল হাকিম জাপান কিংবা ভারতে রয়েছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
আরও তিনজন সাবেক মন্ত্রীরও কোনো হদিস নেই। তারা হচ্ছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) আবদুস সালাম, সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। এই তিনের দু’জন বয়সজনিত কারণে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না।
সাবেক মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে ৯ জনের অবস্থান জানা গেছে। তাদের মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ভারতে আছেন। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ভারত হয়ে অন্য দেশে গেছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রহমান, সাবেক যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী নাজমুল হাসান পাপন, সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এবং সাবেক প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী লন্ডনে রয়েছেন।
উধাও ছয় সাবেক মেয়রও
বরিশালের সাবেক মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহর খোঁজ জানেন না কেউ। লোকমুখে গুঞ্জন রয়েছে, তিনি এখন ভারতে। চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর অবস্থানও কেউ নিশ্চিত করতে পারছেন না। সরকার পতনের আগেই দেশের বাইরে ছিলেন ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। এখন তিনি কোথায় আছেন, তা কেউ নিশ্চিত করতে পারছেন না। তবে গুঞ্জন রয়েছে, তিনি লন্ডনে আছেন।
ময়মনসিংহের সাবেক মেয়র ইকরামুল হক টিটুরও হদিস নেই। তবে স্থানীয় বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে গোপন সমঝোতার মাধ্যমে দেশেই আত্মগোপনে আছেন বলে এলাকায় গুঞ্জন রয়েছে। খুলনার সাবেক মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকও আত্মগোপনে রয়েছেন। তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠজনকে ‘আর রাজনীতি করবেন না’ বলে জানিয়েছেন।
কর্মীর খোঁজে লিটন-আনোয়ার-সূচনা
আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও সাবেক মেয়র দলের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলেও ব্যতিক্রমী ভূমিকায় রয়েছেন দু’জন সাবেক মেয়র। তারা হচ্ছেন রাজশাহীর সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ও সিলেটের সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। এর মধ্যে লিটন গত নভেম্বরের শেষের দিকে ভারত পাড়ি দিয়েছেন। আর সরকার পতনের পরপরই ভারত হয়ে লন্ডনে গেছেন আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। এ দুই মেয়রের সঙ্গে স্থানীয় কর্মীদের যোগাযোগ রয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বলেছেন, ‘দেশেই ছিলাম। কিন্তু সংকট বাড়তে থাকায় টিকতে পারিনি। এখন ভারতেই আছি।’ আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী জানিয়েছেন, জীবনের হুমকি থাকায় তিনি গত ১৪ আগস্ট ভারত হয়ে লন্ডন গেছেন। আর একটু সুযোগ হলেই সিলেটে ফিরে আসবেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় এই নেতা স্থানীয় কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।
কুমিল্লার সাবেক মেয়র ডা. তাহসিন বাহার সূচনা আছেন ভারতে। সঙ্গে আছেন তাঁর বাবা সাবেক এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। তারা দু’জনই কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।
আইভীই একমাত্র ব্যতিক্রম
সরকার পতনের পর আলোচিত সাবেক মেয়রদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটলেও নারায়ণগঞ্জের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর বেলায় এমনটা হয়নি। তিনি নিজের বাড়িতেই আছেন। অন্য মেয়রদের মতো তাঁর বিরুদ্ধেও একাধিক হত্যা মামলা হয়েছে। তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীর নিয়মিত যোগাযোগ আছে।
অসুস্থতা ও বয়সের সুবিধা
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ বেশ কয়েক মাস ধরেই অসুস্থ। রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। এ জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না বলে কেউ কেউ মনে করছেন। দেশে অবস্থান করা সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জেবুন্নেছা হকও অসুস্থ। তিনি হাঁটতে পারেন না। কোষাধ্যক্ষ এইচ এন আশিকুর রহমানও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন।
খোঁজ নেই কেন্দ্রীয় ৪১ নেতার
সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও মেয়রদের মতো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির ২৩ নেতার খোঁজ নেই। তারা হচ্ছেন– সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য্য, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক, মির্জা আজম, এস এম কামাল হোসেন, অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, সুজিত রায় নন্দী, আন্তর্জাতিক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ, কৃষি ও সমবায় সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, ধর্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, বন ও পরিবেশ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুস সবুর, মহিলা সম্পাদিকা জাহানারা বেগম, যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক মাশরাফি বিন মুর্তজা, শিক্ষা ও মানবসম্পদ সম্পাদক শামসুন নাহার চাঁপা, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা সম্পাদক ডা. রোকেয়া সুলতানা, উপদপ্তর সম্পাদক অ্যাডভোকেট সায়েম খান, উপপ্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সৈয়দ আবদুল আউয়াল শামীম, কার্যনির্বাহী সদস্য নুরুল ইসলাম ঠাণ্ডু, বিপুল ঘোষ, দীপঙ্কর তালুকদার, অ্যাডভোকেট আমিরুল আলম মিলন, আখতার জাহান, ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরী, অধ্যাপক মেরিনা জাহান কবিতা, পারভীন জামান কল্পনা, অ্যাডভোকেট সফুরা বেগম রুমি, অ্যাডভোকেট তারানা হালিম, অ্যাডভোকেট হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া, আনিসুর রহমান, সাহাবুদ্দিন ফরাজী, ইকবাল হোসেন অপু, মারুফা আক্তার পপি, উপাধ্যক্ষ রেমন্ড আরেং, অ্যাডভোকেট গ্লোরিয়া সরকার ঝর্ণা, সাঈদ খোকন, আজিজুস সামাদ আজাদ ডন, সাখাওয়াত হোসেন শফিক ও তারিক সুজাত।
একসময়ে খুবই প্রভাবশালী নেতা দলের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদেরও কোনো খোঁজ নেই। কেউ বলছেন, তিনি বিদেশে, তবে তাঁর দেশ ছাড়ার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্যদের মধ্যে ড. মসিউর রহমান, রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু, নুরুল ইসলাম নাহিদ, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, সতীশ চন্দ্র রায়, মোজাফফর হোসেন পল্টু এবং এ কে এম রহমত উল্লাহর কোনো খোঁজ নেই। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী ও মেজর জেনারেল (অ.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকেরও হদিস নেই।
সূত্রঃ সমকাল